গল্পের সরল নায়ক

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী (নভেম্বর ২০১২)

মিজানুর রহমান রানা
  • ২৬
  • ১২
কিছু মানুষ ছিল, আছে পরাজয় যাদের ছুঁড়ে ফ্যালে হতাশার মরুভূমিতে। কোনো কাজে এ শ্রেণীর মানুষরা একবার পরাজিত হলে সেই কাজ আবার করার চেষ্টা না করার রাজ্যের ফিকির এঁরা খুঁজে পায়, আর সেই ফিকিরে এরা নিজেদের চুবিয়ে রেখে বড় বড় শোকের নিঃশ্বাস ছাড়ে আর সুযোগ বুঝে গলাবাজি করে!

কিছু মানুষ ছিল, আছে, পরাজয় যাদের জিদ উসকে তোলে, কোনো কাজে এই শ্রেণীর মানুষেরা একবার পরাজিত হলে ততক্ষণ সেই কাজ সফলের চেষ্টা চালিয়ে যায়, যতক্ষণ না সেই কাজটা অথবা তার সামর্থ শেষ হয়!

হঠাৎ নিজেকে গল্পকার বানানোর প্রয়াসে মেতে উঠা নকীব গুলজার হোসেন প্রভাষক ইসলামের ইতিহাস এই দুই শ্রেণীর মানুষের মাঝে দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তভর্ুক্ত।
কাগজ-কলম এবং সময়ের অপচয় রোধে এখন থেকে আমরা নকীব গুলজার হোসেনকে নগুহো বলবো।

সাধারণ তল্লাশিতে না পাওয়া গল্প নগুহোকে ক্ষেপিয়ে হন্যে কোরে তোলে। যার ধাক্কায় তার সদর অন্দরের তাল জ্ঞানের শৃঙ্খলা চুরমার ভেঙ্গে পড়ে। মুহূর্তে একটি শ্রবণ এবং দৃষ্টি বিভ্রান্তকারী হিংসা প্রযুক্ত আহম্মকির গো তার সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
কিছু সময় ঝিম ধরে সে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে থাকে বিজয় পর্বের পথ ও পদ্ধতির খোঁজে।
চিন্তার চৌহদ্দি সুলুক সন্ধান করে 'গল্প লেখা কোনো কাজের ভিতরেই পড়ে না' তার সারা জীবনের এই বিশ্বাসটা সে বাতিল করে। আর গল্প লেখাটাকে একটা কাজের মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়।

অতপর সে তার কাজের সাথে বাগদত্তা চবি্বশ ঘণ্টা ঘেটে ঘুটে আপাতত না কোরলেও চলে এমন কিছু কাজ বহিস্কারের ভিতর দিয়ে কিছু সময় উদ্ধার করে। আর এ উদ্ধার হওয়া ফাঁকা সময়ের মধ্যে গল্প লেখার কাজটাকে প্রতিস্থাপন করে। 'রাতে খাবার পর শোবার আগে যতক্ষণ ঘুম না আসে' সময় ঠিক হোয়ে যাওয়াতে তার কিছুটা ওজন কমে। সে দোকানে যায়। একটা মোটা ডাইরি কেনে। 'এবার ডাইরিটা ভরতে হবে, ব্যাস' চিন্তাটা তাকে এক ধরনের ফুর ফুর আমেজে স্থাপন করে!
নগুহোর বিশ্বাস তার বানানো গল্প তাকে এনে দিবে বিজয়ের আনন্দ এবং অধিষ্ঠিত কোরবে সুমহান মর্যাদায়। সবচে বড় কথা এটা তার চ্যালেঞ্জ। বিষয়টা ঠিক বাংলায় ব্যাখ্যা হবে না। কারণ ইংরেজি চ্যালেঞ্জ শব্দের বাংলা কোনো প্রতিশব্দ নেই!

যা হোক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে একতরফা শুরু করেছে। সে যাকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়েছে সেই সুলতান মাহামুদ রতন সাহিত্যের শিক্ষক জানেই না যে, তার অর্জিত হোয়েছে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী!

সুলতান মাহামুদ গল্প লেখে, আর তা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়।
সে সব লেখা ছাত্র-শিক্ষকরা পড়ে, ঘটা করে আলোচনা করে, কয়েকদিন আগে সুলতান মাহমুদের একটা গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। যার প্রকাশনা উৎসবে তার লেখার ঢালাও প্রশংসা করা হোয়েছে।
এরপর থেকে কলেজের যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে রতন স্যারের মতামত অনিবার্য হোয়ে ওঠে। শোনা যাচ্ছে বয়স শীঘ্রই বর্তমান অধ্যক্ষকে অবসরে পাঠাবে, তখোন রতন স্যারকেই অধ্যক্ষের চেয়ারে বসানো হবে। এছাড়াও কলেজের বাইরে তার গল্প ছড়িয়ে পড়ে ক্রমপ্রসারিত করে চলেছে তার জনপ্রিয়তা। এই সব সূক্ষ্ন এবং স্থুল কার্যকারণ নগুহোকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়েছে। আর নৌকার একমাথায় ভর চাপালে অন্য মাথা ভেসে ওঠার সূত্রে সুলতান মাহামুদের জনপ্রিয় হোয়ে ওঠা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নগুহোকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে!

নগুহোর মূল্যায়নে সুলতান মাহামুদের গল্প এরকম 'কি লেখে সে? ছাই গবর, সব ফালতু, আজগুবি অর্থহীন, শিক্ষামূলক কিছু আছে ওর মধ্যে? পাবলিক মাতামাতি করে? পাবলিক বোঝে কি? পাবলিক হচ্ছে কাণ্ডজ্ঞানহীন, হুজুগগ্রস্থ, পাবলিক কি কোনো বিষয়ের অতীত-আগামী-তল-উপর খোঁজে না বোঝে? পাবলিক উপর ভাসা যা শোনে তাই নিয়ে অর্থহীন মাতামাতি করে। আমি দেখিয়ে দেবো গল্প কাকে বলে? শিক্ষামূলক, নীতিবোধ, আদর্শবাদ, গণসচেতনতা, ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান থাকবে আমার লেখায়। অবশ্য প্রেমও থাকবে, প্রেম হচ্ছে জীবনের অনিবার্য এবং অবিনশ্বর অধ্যায়। আমি প্রেমের মহত্ব তুলে ধরবো আমার লেখায়!

রাতে খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে নগুহো ডাইরি কলম হাতে বসে গল্পের খোঁজে। হযরত আদম আলাইহিস সালামের পর্ব থেকে সে শুরু করে খোঁজাখুজি। মুসলমানদের জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিমের সময়ে এসে সে একটা হাই তোলে। তারপর সে দ্রুত চলে আসে তুর পাহাড়ে। এখানে সে পর পর দুইটা হাই ছাড়ে। তারপর সে আসে খন্দকের যুদ্ধের মাঠে, তারপর তার আর কিছু মনে থাকে না। সোফায় কাত হোয়ে পড়ে থাকতে দেখে ঠেলেঠুলে বউ তাকে খাটে নিয়ে আসে। তারপর শূন্য পাওয়ারের গোলাপী রহস্যময় আলোয় ধ্বনিত হোতে থাকে তার নাক ডাকা ...।

কিছুক্ষণেই সে হোয়ে ওঠে ফেরাউনের সেনাবাহিনীর এক জাদরেল হাবিলদার। নীল নদের ভিতর দিয়ে তৈরি হওয়া অলৌকিক পথের উপর দিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনীর সাথে খোলা তলোয়ার হাতে সে ধাওয়া করে ছুটতে থাকে পয়গম্বর মুসার গণবাহিনীকে। হঠাৎ সে দ্যাখে হযরত মুসার বাহিনীর মাঝে ঝলমল পোশাক পরে উটের পিঠে সুলতান মাহমুদ! দৃশ্যটাকে সে নিজের জন্য একটা বড় ধরনের সুযোগ বিবেচনা করে। আর ভাবে 'সুযোগ কাজে লাগানোটাই আসল ওস্তাদি, ওকে মেরে ফেলতে হবে।' সে এগিয়ে যায় সুলতান মাহামুদের দিকে। হঠাৎ তার পায়ের তলের পথটা অদৃশ্য হয়। মুহূর্তে প্রবল জলের ঘূর্ণি তাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে। একই সাথে জল তার নিঃশ্বাস বন্ধো করে দেয়। সে হাত-পা ছুঁড়ে মরণ চিৎকার দিয়ে উঠে বসে।

কিছু সময় ঘোর তাকে বুঝতে দেয় না তার অবস্থা ও অবস্থান। সে ভয়ে ভয়ে চোখ খোলে আর দ্যাখে ডায়ালে কাবা শরীফের ছবিঅলা দেয়ালঘড়িতে লাফিয়ে চলা সেকেন্ড। সে ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে চার পাশ দেখে আর সহসা ফিরে আসে নিজের বিছানার উপর।

সে একটা লম্বা শোকের নিঃশ্বাস ছাড়ে আর বলে নিজেকে 'শেষ মেশ শয়তান আমাকে ফেরাউনের দলে ঠেলে দিলো? আর সুলতান মাহামুদকে মুসা নবীর দলে? পর মুহূর্তে মুরুব্বীদের কাছে শোনা একটা কথা তাকে সজীব-চাঙ্গা করে তোলে। সে বলে 'ঠিকই আছে স্বপ্নে সব সময় উল্টো দেখা যায়। বিষয়টা সদর কোরলে আমিই পয়গম্বরের সৈনিক- আর ও অভিশপ্ত কাফির। আমি ধার্মিক সাচ্চা ঈমানদার।' সে নিজের রানে একটা সন্তোষজনক চড় মারে। আর খুশি হোয়ে উঠতে উঠতে ও উঠতে পারে না, রাতে গল্প খোঁজার অভিযানে নেমে ন্যাক্কারজনক পরাজয়ের কথা মনে পড়ায়। সে আর একটা শোকের নিঃশ্বাস ছাড়ে। খাট থেকে নিজেকে টেনে নামায় আর ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে ঢোকায় বাথরুমে এবং একটা অক্ষরও না লিখে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধে নিজেকে ভরে ফ্যালে ধিক্কারে।

গোসল নগুহোর রাগ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন ও শান্ত করে। বাথরুম থেকে বের হতে হতে সে বলে 'গত সন্ধ্যায় কেহ ফিরে যেতে পারে না। কাজেই জীবন থেকে চলে যাওয়া সময়ের যে কোনো কিছুর জন্য বিলাপ অনিবার্যভাবেই অর্থহীন না হবার সুযোগ নাই। সময়ের পথে শুধু সামনেই যাওয়া যায় মানুষেরা পারে শুধু আগামীর রুটিন তৈরি কোরতে। যদিও আগামী নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চয়তায় ভরা। তবুও মানুষের সফলতার আশাবাদী হোয়ে চেষ্টা চালানো ছাড়া উপায় নেই। এজন্যই জীবনমাত্রই চেষ্টা প্রবন। কিন্তু ফল অনেকটাই অনিশ্চিত। আমাকে চেষ্টা কোরতে হবে।

কলেজের পথে সে একটা সূত্র অর্জন করে 'একই উচ্চতার দুইটা বস্তুকে একটার তুলনায় ছোট বানাতে চাইলে হয় একটাকে কিছুটা ছাটতে হবে না হয় একটাকে বড় কোরে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি এই দুই পদ্ধতি একসাথে প্রয়োগ করবো। ওকে ছাটবো এবং নিজেকে বড় বানবো, তাহলে সমীকরণটা দ্রুত সফলতা এনে দেবে।

কলেজ থেকে ফেরার পথে ঠাণ্ডুর মোড়ে ক্রমাগত বেড়ে ওঠা মানুষের একটা তে কোণা জটলা নগুহোকে থামায়। সে ভিড়ের ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়।
ভেতরে হাশেম মিয়া। হাশেম মিয়াকে সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে।
কিন্তু হাশেম মিয়ার ছোটবেলা সে দ্যাখেনি।
হাশেম মিয়ার কিশোরকাল সে দ্যাখেনি।
হাশেম মিয়ার যৌবনকাল তো চলছেই।
হাশেম মিয়ার বুড়ো কাল তো আসেইনি!
বিষয়টা কি? নগুহো ভাবে, 'আমার শিশুকাল ছিল, আমার কিশোরকাল ছিল, আমার যৌবন যাই যাই! তাহলে দাঁড়াচ্ছে কি?'
হাশেম মিয়াকে সে শিশুকাল থেকে একই রকম দেখে আসছে সেভাবে 'হাশেম মিয়া কি শিশু বা কিশোর ছিল না? হাশেম মিয়া কি চিরকাল যৌবনপ্রাপ্ত? হাশেম মিয়ার বৃদ্ধকাল থাকলেও অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তার বৃদ্ধকালের সাথে আমার দেখা হবে না। কারণ তার ভিতরে বৃদ্ধ হবার কোনো লক্ষণ নেই। সে বৃদ্ধ হবার আগেই হয়তো আমার বাতাসের চালান শেষ হোয়ে যাবে।' বিষয়টা তাকে ঘাবড়ে দেয়।

কে এই হাশেম মিয়া?
সে হাশেম মিয়া বলতে যাকে দেখে আসছে, তার বয়স পঁয়ত্রিশ-ত্রিশ বা পয়ঁতালি্লশও হোতে পারে। বিশ বছর আগে যা ছিল সে দেখতে এখনও তাই। মাঝারি উচ্চতা, পেছন ঠেলা ঝাঁকড়া চুল। চওড়া কপাল, কিছুটা চারকোণা ধরনের মুখ, টানা নাক, চাপা চোয়াল, পাতলা ঠোঁট, পরিপাটি ঝকঝকে দাঁত, চিকন গোঁফ, ভাসা চোখে রাজ্যের বিস্ময়! রং চাপাশ্যাম, মেদহীন টান টান শরীর, পরে আয়রনবিহীন ঢোলা সুতি প্যান্ট, জামা আর চপ্পল! অবশ্য এটাই তার কমন আকৃতি নয় মাঝে মাঝে তাকে অন্যরকমও মনে হয়।

সে মোড়ে মোড়ে, গ্রামে, হাটে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে গল্প করে। তার গল্পের চারপাশে বহু বহু মানুষ জমা হয়।
হাশেম মিয়া সব সময় নতুন নতুন গল্প কয়!
হাশেম মিয়া এক গল্প দুইবার কয় না।
তার গল্পে অনেক অনেক দিন আগের কোনো রাজা, রাজপুত্র, হাতি-ঘোড়া, রাজকুমারী, সেপাই-মন্ত্রী, রাক্ষস-খোক্কস, অলৌকিক ক্ষমতাধর কোনো দরবেশ নেই। তার নায়ক-নায়িকা ঘটনা চারপাশ থেকে উঠে আসে। হেসে গেয়ে অভিনয় কোরে হাশেম মিয়া গল্প কয়। তার ভাষা-ব্যাকরণ এবং পাণ্ডিত্যের কর্কশ জটিলতামুক্ত সরল, গতিময়, প্রাণের আবেগে উচ্ছল এবং আঞ্চলিক। লোকেরা গল্প শুনতে শুনতে তার পায়ের কাছে টাকা ছুঁড়ে মারে। কে কত দেয় সে দ্যাখে না, গল্প শেষ হলে হাসিমুখে টাকাগুলো খুটে পকেটে রাখে।

হাশেম মিয়ার গল্পের চরিত্ররা হাসলে তার শ্রোতারাও হাসে!
হাশেম মিয়ার গল্পের চরিত্ররা কাঁদলে তার শ্রোতারাও কাঁদে!
হাশেম মিয়ার গল্পের চরিত্ররা সুখী হলে তার শ্রোতারাও সুখী হয়!
হাশেম মিয়ার গল্পের চরিত্ররাই তার গল্পের শ্রোতা!
নগুহো ভিড় ঠেলে সামনে চলে আসে।
হাশেম মিয়া গল্প বলে সজীব ভরাট কণ্ঠে।
'তারপর কি হোইলো?'
কি হোইলো? আফনেরা কোইতে হারেন? কোইতে হারেন না? তয় হুনেন। শহুরের বউ লোইয়া হে ভাইগ্যা গেল দক্ষিণ দ্যাশে। হেই দ্যাশ তাগো কাছে অচিন দ্যাশ। হেই দ্যাশে তারা অচিন মানুষ। হেই দ্যাশে তার শহুরের বউ শুক্কুর আলীরে নিজের মইদ্দে হান্দাইয়া কোইলো, বহুত আইচ্চা, বুইলে মিয়া ভাই, দুনিয়া দারিত কেউ কারও কিচ্ছু হয় না, আবার হগ্গলে হগ্গলের আত্মীয়। মায়াডা যদি না থারয়ে তয় সব বান্দন খোইস্যা যাইবো। আর একজোনের উপর আর একজোনের মায়া যদি ধরে রে পরান! মায়া এমুন আডা হে মানষে মানষে এ্যামুন জুইড়া দেয় যে এ জনমে আর ছাড়ে না। মায়া ছাড়া সব সম্পক্ক হোইলো মিথ্যা। ফসকা বান্দা, একটু স্বার্থের বাতাসে টান লাগলে খুইলা যায়। বুইলে, শাউড়ি জামোই বলতি কেউ নাই। আসল হোইলো, আসল হোইলো কি?
সে লয় সমৃদ্ধ সুরে একটা গান ধরে।
'অল্প বয়সের পাতলা নাগর
ও নাগর হে লিয়া পড়ে গায়
নাগর উড়াইয়া নিবার চায়
অল্প বয়সের পাতলা না-গ-র....।
তারপর সে দর্শকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়,
আসল হোইলো কি? কোইতে হারেন না?
আসল হোইলো মায়া আর মদ্দা,'
শ্রোতারা হৈ হৈ করে ওঠে, শিষ বাজায়, চারপাশ থেকে টাকা ঝরতে থাকে অঝোর। নগুহো 'আস্তাগ ফিরুল্লাহ' বলে ভিড় থেকে ছিটকে বেরিয়ে হন হন হেটে বাড়ি চলে আসে।
রাত নয়টা সতের 'কোনো বাহানা চলবে না, আজ তোমাকে কমপক্ষে একটা গল্প লিখে দিতেই হবে' এই দায়িত্ব নগুহো নিজের উপর চাপায়।

'বরং একটা রোমান্টিক গল্প লেখা যাক, সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কোনো কাহিনী লেখাই উত্তম। হঁ্যা অভিজ্ঞতা!' ভাবতেই তার সামনে চলে আসে চামেলি। গ্রামে তার জমির বর্গাচাষী এবং সম্পর্কে চাচাতো ভাই এমদাদুলের বউ চামেলি। ফর্সা, মেদহীন ধারালো মাংসল শরীর আর ভেজা ভেজা পুরু ঠোঁট। সে আর ভাবতে পারে না, নিজের ঠোঁট চাটে দুবার। আর বলে নিজেকে 'পরকীয়াতেই প্রেমের আসল আনন্দ!'
আমি কি কোনো পাপ কোরেছি? আরে ধুর, সম্মতিতে পাপ নাই। কেনা বেচাতেও পাপ নাই। আল্লাহ্ ব্যবসাকে কোরেছে হালাল। আমি প্রতিবার ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরি পরিশোধ কোরেছি। আমি ঘেমে যাই এটা ঠিক আছে। কিন্তু চামেলি কি ঘেমে ছিল? খেয়াল করা হয়নি।
চিন্তার এই সিঁড়িটা তাকে উত্তেজনার চূড়ান্ত স্তরে পেঁৗছে দেয়। অতপর সে পাশের খাটে ঘুমিয়ে চিৎ, বৌকে দ্যাখে, আর সামর্থের সর্বোচ্চ দ্রুতগতিতে সে নিজেকে সওয়ার করে বউয়ের উপর...।

পর সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই রাতের কৃতকর্মের অনুশোচনা তাকে ছোবলাতে শুরু করে। ধারাবাহিক পরাজয়ের অশান্তিতে ধুকতে ধুকতে সে নিজেকে বাথরুমে ঢোকায় আর মুখোমুখি হয় আয়নার। তার দিক পিট পিট তাকিয়ে একজন। অর্ধেক টাক! মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে। নিচের দিকে ঝুলেপড়া ফোলা চোয়াল। খোচ খোচ পাকা কাঁচা দাড়ি। ভোতা নাক মোটেই মানায়নি মুখের সাথে, যেনো ডুপ্লিকেট, অর্জিনালটা খোয়া যাওয়ার পর, কাঁচা হাতের কারিগরের বানানো, ঠিকভাবে বসানো হয়নি। যে কোনো মুহূর্তে খুলে যেতে পারে। নাকের মাথায় একটা লালচে অাঁচিল। যেন আটুলি, যা তার সমগ্র মুখমণ্ডলে একটি কদাকার ইমেজ হোয়ে ফুটে আছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ায় ঝলসে যাওয়া কালচে ঠোঁট, যথেষ্ট কুৎসিত।
কোটরে ঢোকা চোখে রাজ্যের ক্লান্তি। থুতনির নিচ থেকে তিন স্তর ভাঁজপড়া বেটে মোটা গর্দান। আয়নার মুখটাকে তার নির্বোধ হাস্যকর এবং গঠনগত ব্যাকরণ অশুদ্ধ মনে হয়।
হাহাকার ভরা একটা শোকের নিঃশ্বাস ছেড়ে সে আয়না থেকে চোখ সরায়। দেয়ালে লেগে থাকা একটা পেট মোটা টিকটিকির উপর।
সে আবার চোখ ফিরিয়ে আনে আয়নায়, আর আয়নার মানুষটার মধ্যে মরিয়া হোয়ে খুঁজতে থাকে স্মার্ট সুদর্শন কিছু। হঠাৎ আয়নার মুখটা সরে যায়। আর আয়নার ভিতরে আর একখানা আয়না তৈরি হয়। আর সেখানে ভেসে ওঠে হাসিখুশি মাথা ভরা চুল সুদর্শন সুলতান মাহামুদ।
মুহূর্তে নগুহোর অন্তর ভরে ওঠে দগদগে ঘৃণায়। সে বলে 'ওর সবকিছু ভড়ং, ও একটা নচ্ছার, ওর বউ একটা খারাপ মেয়ে মানুষ।
কিন্তু আমিই বা ক্যামোন?
কতোদিন হোয়ে গেল অথচ একটা গল্প খুঁজে পাচ্ছি না।'
সে খুব রেগে যায় আর ভাবে নিজের পাছায় একটা লাথি মারতে পারলে শান্তি হতো। সে পিছনে পা বাকিয়ে চেষ্টা করে নিজের পাছায় একটা লাথি মারার। এই চেষ্টা তাকে উপুড় করে ফেলে দিতে যাচ্ছিল। সে দেয়ালে হাত বাড়িয়ে কোনোরকমে নিজকে রক্ষা কর। প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার বিকল্প হিসেবে নিজের ডান পা তুলে সে তার বা পায়ের হাটুর নিচে একটা মাঝারি ধরনের লাথি মারে। তারপর দু'পায়েই ব্যথা পেয়ে হেসে ওঠে আর বলে 'সুস্থতার জন্য মাঝে মাঝে ঠিকমতো কসন বেশ ধনন্তরি।

কলেজে যাবার প্রস্তুত হোতে হোতে নগুহো নিজেকে একটা রায় শোনায়।
'আজ সকালে তোকে খেতে দিবো না। আর রাত তিনটার আগে ঘুমাতে পারবি না। এটা গত কয়েকদিন তোর উপভোগ করা অলসতা আর আহম্মকির শাস্তি। আশা করি কল্যাণকর এই শাস্তি চিকিৎসা তোর অতিরিক্ত রসের ভাব পরিমিত মাত্রায় নামিয়ে আনবে, আর নিজের কাজে দায়িত্ববান হোতে তোকে প্রভাবিত কোরবে।'

নগুহো কলেজে বসে সিদ্ধান্ত নেয় তার জানা জীবিতদের মাঝে সবচে বড় জ্ঞানী তার এক সময়ের শিক্ষক পীর আমির আলীর কাছে যাবে। পীর আমির আলী এলমে মারুফাতের উপর তিনখানা বই রচনা কোরেছে। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার বহু সংখ্যক ভক্ত, মুরিদ আর ছাত্র। পীর আমির আলীকে তার ভক্ত মুরিদরা ভক্তিভরে পি, আ, আ হুজুর বলে। অবশ্য শাদা কাক বলতেও তাকেই বোঝায়। তার চুল-দাড়ি পোশাক শাদা এ কারণে তিনি শাদা কিন্তু শাদা কাক নন। যেহেতু শাদা কাক জগতে বিরল পক্ষি সে কারণে তিনি হন শাদা কাক!
শাদা কাকের কাছে যারা আসে ভক্ত-মুরিদ, সমস্যাগ্রস্ত, পরিচিতি, অপরিচিত সবার ব্যাপরেই তিনি আন্তরিক একই সাথে সকলেই তার কাছে পাত্তাহীন। তার ভাষা ঢাকনাহীন, দেয়াল বর্জিত, এবং শালীন অশালীন নিরপেক্ষ। বরং কোনো ভণিতা ছাড়া তার মেজাজটাই তার মুখ দিয়ে বেরোয়।
তার মেজাজ যদি ভালো থাকে তো ভালো, আর যদি তার মেজাজ ভালো না থাকে তো ভয়ঙ্কর। কেহ জানে না কি ঘটবে।
যে বা যারা শাদা কাকের গালি বা চড় খায় তারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করে। কারণ শাদা কাকের চড় বা গালি খাওয়া মানে তার ছোটখাট পাপের দুনিয়াতেই নিষকৃতি হোয়ে যাওয়া। যারা শাদা কাকের শাব্দিক বা বস্তুগত ধোলাই খায় তারা তা গর্বের সাথে প্রচার করে পরম সন্তোষে ...।

নগুহোর ছালামের জবাবে শাদা কাক বলে 'বল এবং সংক্ষেপে।'
নগুহো শাদা কাকের হাত জড়িয়ে ধরে বলে 'আমাকে দয়া করুন।'
'হাত ছাড় চেমটোচ্ছিস ক্যান, এই তুই কি জানোয়ার, যে নখ কাটিস না? এই বিটা তোর সমস্যা কি?'
'আমি গল্প লেখক হোতে চাই।'
'হ গে, আমি তো তোকে মানা কোরি নাই।'
'কিন্তু আমি কোনো গল্প খুঁজে পাচ্ছি না।'
'দ্যাখ বাপু, তুই শিক্ষক, ছাত্র নোস যে ন্যাকামী তোকে মানাবে। গল্প খুঁজে পাওয়ার কোনো তদবির আমার জানা নেই।'
'আপনি আমার শিক্ষক, আমাকে দয়া করুন। আমাকে একটা পথ দেখান।'
'ওই যে দ্যাখ একটা পথ, ওই পথের নাম যশোর রোড। ওই পথ খুলনা থেকে শুরু হোয়ে যশোর মাগুরা ফরিদপুরের ভিতর দিয়ে পদ্মা পার হোয়ে মানিকগঞ্জ সাভার হোয়ে রাজধানীতে ক্ষ্যান্ত।'
'আমি ওই পথের কথা বলিনি।'
'বান্দরের ছাও তুই কোইছিস একটা পথ দ্যাখাতি। আমি তোকে একটা পথ দ্যাখাইছি। ওই পথ ছাড়া এখান থেকে আর কোনো পথ দেখা যায় না। তুই যদি এখানে ধন্না না দিয়ে দুনিয়াদারিতে ঘুরিস তাইলে অনেক রকম এবং গন্তব্যের পথ পাবি।'
'না মানে আমি আসলে কীভাবে গল্প খুঁজে পাবো তা জানতে যাচ্ছি।'
'গল্প দিয়ে তুই কি কোরবি?'
'লিখবো।'
'কোটি কোটি বার চেষ্টা কোরেও মহিষ ডিম পাড়তে পারবে না। সে রকম চেষ্টা করে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। এটা নব্বই ভাগ স্বভাবজাত। স্বভাবে বিজটা থাকলে চেষ্টা কোরে উৎকর্ষ ঘটানো যেতে পারে। কিন্তু ভেতরে বিজ না থাকলে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।'
'আপনি আমার ভিতরে সেই বিজটা পুঁতে দেন।'
'তুই হাশেম মিয়াকে চিনিস?'
'জ্বী।'
'তার কাছে যা, আমার জানামতে হাশেম মিয়া হচ্ছে সবচে ভালো গল্পকার।'
'সে তো গল্প লিখে না, তার লিখিত কোনো গল্প নেই। সে বানিয়ে বুনিয়ে গল্প করে, তার গল্প অশ্লীল।'
'তুই নিজে অশ্লীল। তুই একটা কুপ্রস্তাব, তুই আমার কাছে আসা মানে হচ্ছে আমার কাছ একটা কু-প্রস্তাব আসা। তুই হাশেম মিয়াকে চিনিশ?'
'তাকে শহরে দেখেছি। কিন্তু সে কোথায় থাকে আমি জানি না। '
'সে থাকে তার গল্পের মধ্যে।'
'তার জন্ম কোথায়?'
'তার জন্ম তার গল্পের মধ্যে।'
'তার বয়স কত?'
'তার কোনো বয়স নেই, সময় তার ওপর ক্রিয়াহীন।'
'সে কি যুবক?'
'না।'
'সেকি বৃদ্ধ?'
'না।'
'তাহলে?'
'হাশেম মিয়া একটা কাহিনী, একটা গল্প, আর গল্পের কোনো বয়স থাকে না, হাশেম মিয়া বলতে কেহ নাই যা আছে তাহলো গল্প।'
'আমি জন্ম থেকেই তাকে দেখে আসছি, তার বিদ্যমানতার মাঝে কি কোনো সন্দেহ আছে?'
'সন্দেহ নাই, তবে যা দেখা যায় তা আসলে কি? দেখা সত্যের গভীরে আছে আরও নিগুঢ় সত্য, যা দেখা যায় তিন নম্বর চোখে। তুই নিজেকে যা মনে কোরিস, তুই কি তাই? পরিবার, ইশকুল, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতিসংঘ তোর মেমোরিতে যে সফট্অয়্যার পান্চ কোরেছে, তুই নিজেকে সে রকম মোনো কোরিস, তুই আসলে যে তার সাথে তোর আজও দ্যাখা হয়নি। তাকে দেখতে হলে অনেকগুলো নিষিদ্ধ দেয়াল তোকে টপকাতে হবে। আমি বিশ্বাস কোরি তোর মত একজন চাকরের পক্ষে সে ধরনের দেয়াল টপকানোর সাহস হবে না। মূলত দেয়ালগুলো এতো ব্যাপক আর সুক্ষ্ন যে দেয়ালগুলো তুই খুঁজে পাবি না। আসল কথা হচ্ছে চুদির পুত মিডল ক্লাস তুই সে দেয়ালগুলো খুঁজবিই না, আর তুই কে তা জেনেই তোর সুবিধাবাদী চাকর জীবনের অপসারণ হবে।'
'আপনি আমার মাঝে গল্পের বিজটা পুতে দিন। আমাকে দয়া করুন। আমি অত তত্ত্ব বুঝি না।'
'ব্যাপারটা বোঝ, শামাকের পেটে কখনও মুক্তা হবে না। সে যত চেষ্টাই কর মদ্দা গরু দুদও দিতে পারবে না, বেশি টানাটানি কোরলি মদ্দা গরু তোর মাথা ভরে মুতে দিতে পারবে। কারণ এই-ই তার দেয়ার সামর্থ আছে।
দ্যাখ বাপু প্রকৃত কবি-সাহিত্যিকরা সাধন-ধ্যান জগতের বাসিন্দা, তাদের সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। তবে দুনিয়ার নিজের সহ তার ভেতর-উপর অন্তরিক্ষের প্রত্যেক ব্যক্তি, বস্তু বিষয়ের কাহিনী আছে। সবাই এবং সব কিছু কথা বলে। যে জানে তার সাথে পাথরও কথা বলে। প্রত্যেকের ভাষাটা জানতে হবে। শুধু ভাষা জানলেই হবে না। তার ভাব এবং স্বভাব বুঝতে হবে। খুঁজতে হবে, তবে ছেঁড়া জুতা সেলাইয়ের কৌশল আর জ্ঞান দিয়ে তো মহা সাগরের রহস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। আন্দাজে এ্যাঙ্েিডন্ট ছাড়া আর কিছু অর্জন সম্ভব না।
যা হোক যে কোনো কিছু খুঁজলেই তুই তার মাঝে গল্প পাবি। হোক সে গবরে পোকা, সেনা প্রধান, লড়াইয়ের ষাড় অথবা কাঁচা পায়খানা, সবারই কাহিনী আছে । এই কাহিনীটা তোকে খুঁজে বের কোরতে হবে আর তা সাজিয়ে-গুছিয়ে অলংকরণ কোরলেই গল্প।
এই বিষয়গুলো একমাত্র দীর্ঘ অনুশীলনের ভিতর দিয়েই আয়ত্বে আসে, মুখস্ত করে এই বিদ্যা আয়ত্ব যোগ্য নয়।
আচ্ছা, তুই আমাকে বলতো তুই কেন গল্প লিখতে চাস?'
'আমি স্যার গল্প লিখে নাম কোরতে চাই। আমি আসলে এ্যামোন কিছু কোরতে চাই যা দ্রুত আমাকে বিখ্যাত কোরে তুলবে, আর সবার মুখে মুখে ফিরবে আমার নাম।'
'দুর হারামীর বাচ্চা, এতোক্ষণে তুই তোর আসল পরিচয় দিলি? তুই হোলি শুকোরের মুখোশপরা নেড়িকুত্তির বাচ্চা। বংশ পরম্পরায় মলখোর, এই মলকীট, তুই রাতারাতি বিখ্যাত হোতে চাস? বেশ যা বাজারী কাগজের কয়েকজন সাংবাদিক ভাড়া করে সাথে নিয়ে চৌরাস্তায় বস। তারপর চামুচ দিয়ে একথাল গু খা, দেখবি রাতারাতি তুই বিখ্যাত হোয়ে যাবি। আর মানুষের মুখ থেকে মুখে ফিরবে তোর নাম আর অঘটন পূর্ব কীর্তি। বের হ শালা, আমি তোর চৌদ্দগুষ্টির জামাত কোরি। তোর মা পথে পথে চৌদ্দ জায়গায় নিজামী কোরে তোরে জন্ম দিছে।'
এরপর শাদা কাক স্যান্ডেল খুলে নগুহোকে পেটাতে শুরু করে।
নগুহো পড়িমরি দৌড়ে পালায় ...

নগুহো পথে এসে হাসে আর বলে নিজেকে 'আমি তো কোনো মিথ্যা কথা বলিনি। তাহলে স্যার রাগলেন ক্যানো? যাগগে স্যারের স্যান্ডেলের বাড়ি মানে স্যারের দোয়া, আসলে স্যারের রেগে ওঠা স্যারের ব্যক্তিগত । ও ব্যাপারে আমার নাক গলানো বেয়াদবির পর্যায়ে পড়ে।
আমার যা দরকার তা আমি স্যারের কাছ থেকে পাইছি। হঁ্যা, আমাকে খুঁজতে হবে, সবকিছুর মাঝেই গল্প আছে, আমার কাজ তা খুঁজে বের করা।

সে পথে যা দ্যাখে তার মাঝেই খুঁজতে থাকে গল্প ...
রিকশায় বোরকা পরা যুবতি। তিন যুবক হাত নাড়ে, হাসে, কথা বলে হেঁটে যায় দক্ষিণ থেকে উত্তরে। সন্ধ্যা হোয়ে আসা দিনের দোয়াশ আলোয় রহস্য ঘনানো রাস্তায় বোরকা পরা যুবতি ছোঁয় রিকশাঅলার ঘামে চকচকা পিঠ। রিকশা থামে গলির মুখে। গলির ভিতর থেকে এক যুবক উড়ে এসে বোরকা পরা যুবতির বাঁ পাশে বসে। রিকশাঅলা নিজেকে উপুড় করে রিকশার তলে, বাতি জ্বালাতে।
যুবক হাত চালান দেয় যুবতির বোগলের তল দিয়ে। যুবকের হাতের যাত্রা বাধাহীন কোরতে যুবতি তার বোগল ফাঁক করে। যুবক-যুবতী পরস্পরকে জড়িয়ে গভীর চুমু খায়। যুবক-যুবতীর মগ্নতার কাছে দুনিয়াদারি তোয়াক্কাহীন হোয়ে ওঠে। রিকশাঅলা বাতি জ্বালিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার সোয়ারীদের দ্যাখে, তার মুখে উদ্ভাস হয় সমর্থনের হাসি এবং বাহবা। দৃশ্যটা তার ভিতরে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি করে। সে রিকশার সিটে একটা চাপড় মারে, রিকশাটাকে সামনে ঠেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠে সিটে। রিকশা চলে যায় বাঁক ঘুরে চোখের ওপাশে।
নগুহোর নিঃশ্বাস গরম হোয়ে ওঠে। সে দু'বার নিজের ঠোঁট চাটে। সেই মুহূর্তে একজন বাজারের থলে হাতে কর গুণে গুণে হিসাব কোরতে কোরতে যায় প্রতিকারহীন শোচনীয় বাজেট ঘাটতি আর তারল্য সঙ্কটে ধুকতে ধুকতে ...।
মিলিটারি বোঝাই একটা ট্রাক ছুটে যায় বিপুল দম্ভে।
গল্পকরা তিন যুবক হাঁটতেই থাকে, হাসতেই থাকে! কারা যেন হাত্তালী দেয় সম্মিলিত।
কয়েক ঘূর্ণি বাতাস গড়িয়ে যায় দক্ষিণ থেকে উত্তরে। ঝরা পাতারা মুরগির বাচ্চা হোয়ে ছোটে দিক্বিদিক ...।
অন্ধকার ঘনায়। বাতাস যায় থমকে। সাথে সাথেই চারপাশ একদম চুপ।
হঠাৎ অন্ধকার ফালা ফালা করে বিদু্যৎ চমকায় সাথে মেঘের হুংকার।
বৃষ্টি শুরু হয় বড় বড় ফোঁটায় ফাঁকা ফাঁকা, মুহূর্তে অঝোর ...।
পথের লোকজন ছোটে আশ্রয়ের খোঁজে। নগুহোর কাছে বৃষ্টি পাত্তা পায় না। সে বৃষ্টির মাঝে খুঁজতে থাকে গল্প। সে শুরু করার চেষ্টা করে একটা কাহিনী, সাজাতে চায় ঘটনার পর ঘটনা। কিন্তু কোথা থেকে, কীভাবে কি শুরু করবে তা ভেবে পায় না।
হঠাৎ তার নিজেকে অন্য কেহ মনে হয়। সে ভাবে 'এই ভয়াবহ প্রবল বৃষ্টিতে সবাই যখোন যে যার বাড়িতে পরম শান্তিতে আপনজনদের সাথে শুয়ে বসে, গল্প হাসি আনন্দে ব্যস্ত। সেখানে পচা ড্রেনের সাথে একাকার জল জমা রাস্তায় ছপছপিয়ে কোন বেয়াকুফ হেঁটে বেড়াচ্ছে। কে নিজেকে এভাবে হেনস্তা কোরছে? কে সে? অবশ্যই আমি না।'
সে তার জলে কুঁকড়ে মুকড়ে যাওয়া হাত সামনে মেলে ধরে আর বলে 'এই হাত কার হাত? যার হাত তাকে কি আমি চিনি? চিনি না। গল্পটা এখান থেকে, এই বৃষ্টির থেকে কীভাবে শুরু করা যায়?
বৃষ্টি সবকিছু ধুয়ে গলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার ভয় শুরু হয়,
'বৃষ্টি হয়তো আমাকেও গলিয়ে ধুয়ে নিয়ে যাবে, ড্রেনের জলের সাথে একাকার হোয়ে আমি ভেসে যাবো কোনো অচিন ভাগাড়ে। আরে ধুর এসব কি ভাবতিছি'! হঠাৎ কোথা থেকে এক কুত্তা এসে তার হাঁটুর নিচের ডান পা ধরে টান মেরে, তার চিন্তাটা ছিড়ে ফেলে। সে চমকে ওঠে, আর পা দিয়ে কুত্তাটাকে ঝাড়া লাথি মারে। সাথে সাথেই তার প্যান্টের কুঁচকির সেলাই ছিড়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে। কুত্তার কামড় আর ছেড়া প্যান্ট তাকে ফিরিয়ে আনে নিজের মধ্যে।
বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা জ্বর বাধিয়ে, কুত্তার কামড় খেয়ে এবং কেন যেন আমুদে হোয়ে নগুহো বাড়ি ফেরে। বউ তাকে দেখে অাঁতকে ওঠে। সে কাঁপতে কাঁপতে হাসিমুখে বউকে বলে 'সমস্যা নাই, কুত্তায় কামড়াইছে।'
'তুমি আমারে বাঁচতি দিবা না।'
'ক্যান, আমি তুমার কি কোরিছি?'
সে ডান হাটুর উপর পর্যন্ত প্যান্ট টেনে তোলে। বউকে দেখায়, ছোট একটা লালচে অাঁচড়ের দাগ, তারপর ঘরে ঢোকে।

সকালে নগুহো এর ওর কাছে শুনে রিকশায় ঘুরে ঘুরে হাশেম মিয়াকে খুঁজে বের করে উত্তর পৌর এলাকায় পরিত্যক্ত সামন্ত রাজাদের ভাঙ্গাচোরা ভবনের দোতলায় এক রুম থেকে। সে হাশেম মিয়াকে বলে,
'হাশেম ভাই স্লামালেকুম।'
'হুঁ।'
'হাশেম ভাই, আমি আপনার কাছে আসছি।'
'বয়েন।'
'আমাকে চিনেন?'
'কন কিয়ের লাইগা আইছেন?'
'আপনি কি এখানেই থাকেন?'
'কিয়ের লাইগা আইছেন তাই কন।'
'হাশেম ভাই আমাকে পীর আমীর আলী স্যার আপনার কাছে পাঠাইছেন।'
'ওই মিয়া অতো না পাইদ্যা হাইগ্যা ফ্যালান। হেইডা কন ছারে কিয়ের লাইগা পাডাইছে?'
'আমি গল্প লিখতে চেষ্টা কোরছি।'
'তো, তয়?'
'আপনার সাহায্য চাচ্ছি।'
'কিয়ের সাহায্য?'
'আমি কোন গল্প খুঁজে পাচ্ছি না।'
'দ্যাহেন, আমার কাম আছে ফাজিল কথা বাদ দিয়ে আসল কথা কন।'
'আমি জানতে চাচ্ছি আপনি কীভাবে গল্প তৈরি করেন?'
'সুমায় নষ্ট করতাছেন, আমার আজ ট্যাকার দরকার, আপনি আমারে ট্যাকা দিবেন?'
'কত টাকা চাই আপনার?'
'তেরশ পঞ্চাশ টাকা।'
নগুহো পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে, হাশেম মিয়াকে তেরশ পঞ্চাশ টাকা দেয়।
হাশেম মিয়া হাসে আর বলে 'আচ্ছা মানুষ তো আপনি, সত্যিই ট্যাকা দিলেন?'
'দিলাম তো।'
'ঠিকাছে কন কি কোইতাছেন?'
'আপনি কীভাবে গল্প তৈরি করেন?'
'তোয়ের করমু ক্যা তোয়ের হোয়েই আছে, আমি খালি সাজায়ে কোই।'
'এখানে এমন কি আছে যার মধ্যে গল্প আছে?'
'কিয়ের মধ্যে নাই হেইডা কন?'
'ঐ যে দলা করা শুকনা পাতার মধ্যে কি গল্প আছে?'
'এই পাতা গুলান যে ম্যায়াডা কুড়াইছে হেই ম্যায়েডার নাম কদবানু, সুন্দরী কন্যা কদবানু। পাতাকুড়ানি কদবানু, সারাদিন গাছের পাতা কুড়ায়, গাছের পক্ষিরা হেরে দেইখ্যা গান গায়, কদবানুর মা নাই, বাপ নাই দাদির লগে থায়ে। রাজধানীতে চাকরি করা বরকত উল্লার পোলা রবিউল বারিত আইয়া কদবানুরে দ্যাখে। দেখখ্যাই কদবানুর রূপে হেই পোলা পাগল হোইলো। এই যে শুরু হোইলো গল্প, এই গল্পরে এই বার যেদিক ইচ্ছে মিলনে না বিরহে লোইবেন হেইডা হোইলো আপনের ব্যাপার।'
নগুহো অবাক হয়, তারপর বলে 'ঠিক আছে এবার বলেন এই ছেড়া স্যান্ডেলটার মধ্যে কি গল্প আছে?'
'এই ছেড়া স্যান্ডেলডা এক সুমায় ভালো আছিলো, দুনিয়ায় যতো ভালো স্যান্ডেল আছে তার সবই একদিন ছেড়া স্যান্ডেল হোইবো, যার মানে প্রত্যেক ভালো স্যান্ডেল একদিন ছিড়ার স্বাদ অনুভব করবে। এখুন এই স্যান্ডেল যে পায়ে থাইক্যা ছেরছে, হেই পায়ের মালিকের নাম রহিমওদ্দি, সবাই কয় পাগোল রহিমওদ্দি। হে কিন্তুক জন্মের তে পাগোল আছিল না, হাতেম মাতবর মাঠ জরিপের সুমায় হের সব জমি বেনামি কোইরা হেরে ভিটেছাড়া কোরছে। আর মিথ্যে ডাকাতি কেসে ফাইস্যা সাত বছর জেল খাইট্যা রহিমওদ্দি এখুন পথে পথে ঘোরে। তারে হগ্গলে পাগোল কয়। কিন্তুক যে হ্যারে পাগোল কয় হে তারে কয়, পাগোলের পথ্থম লক্ষণ হোইতাছে হ্যারা দুনিয়ার তাবোৎ ছুস্থ মানষেরে পাগোল কয়।
ব্যাস হোইলো? এ্যাহোন রহিমউদ্দিরে লোইয়া আফনে রাজনীতি, যুদ্ধ, কাজে ডাঙ্গা, মামলা-মকদ্দমা, প্রেম সব করাইতে হারেন।'
নগুহো চিৎকারে কোরে ওঠে। চমৎকার আমি বুঝতে পারছি। পি আ আ স্যার ঠিকই বলেছেন, সবকিছুর মাঝে গল্প আছে। আমাকে খুঁজতে হবে। সে হাশেম মিয়াকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেয়।

সে পথে হাঁটতে থাকে। আর ধীরে ধীরে তার শরীরের উত্তাপ বাড়তে থাকে, একই সাথে মাথায় যন্ত্রণাসহ ভেতর থেকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তীব্র জ্বর তাকে সম্পূর্ণ দখল করে। সে কাঁপতে কাঁপতে রিকশায় উঠে বাড়ি চলে আসে। গল্পের কথা তার মনে থাকে না।

পর সকালে নগুহোর অন্যদিনের তুলনায় দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে। জ্বর নেই, তবে শরীর জুড়ে ম্যাজ ম্যাজ ক্লান্তি।
সে টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজ নিয়ে সামনে মেলে ধরে, তার অভ্যাস প্রথমে পেপার উল্টে উল্টে শিরোনাম পড়া। তারপর পছন্দের সংবাদ বিশদ পড়া।
পেপারের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় এসে সে থমকে যায়। এক সুক্ষ্ন অন্তর জ্বালা দ্রুত ক্রোধে বিকশিত হোয়ে তাকে দখল করে। সাহিত্য সাময়িকীর পাতা থেকে তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে সুলতান মাহমুদ রতন। নিচে তার সাক্ষাৎকার। সে পেপারটা ছুঁড়ে ফ্যালে আর বলে 'হকারকে পেপার দিতে মানা কোরতে হবে। পেপার অলারা পয়সা খেয়ে রতনের মত অপদার্থের ছবি আর সাক্ষাৎকার ছাপে, আর আমিও কি অপদার্থ যে ওইসব ছাইপাস পয়সা দিয়ে কিনবো? কক্ষনো না। কিন্তু আমিও তো এ্যাতোদিনে একটা গল্প খুঁজে পাইনি?'
সে দ্রুত গোসল নাস্তা সেরে পথে বের হয় ...।
আবহাওয়া তার মন ভালো করে দেয়।
গত দু'দিন বৃষ্টি বাতাস কেচে মেজে শহরকে পরিষ্কার করেছে।
ধুলো-ময়লা ধুয়ে যাওয়াতে, গাছেরা হোয়ে উঠেছে সজীব-সবুজ। সজীব হাওয়া বইছে ধীর লয়ে। শব্দ-কোলাহল নেই।
আজ সবকিছুর মাঝেই নগুহো অনুভব করে অন্যরকম কিছু।
এক ছেলে তাকে ছালাম দেয়। সে উত্তর দেয় পূর্ণ। এটা সে আগে কখনও করেনি, সাধারণত সে ছালামের জবাবে বলে, 'হু'।
মোড়ের দোকানে তিন অপরিচিত লোকের সাথে দাঁড়িয়ে কাঁচের গ্লাসে ফু দিয়ে চা পান করে। তারপর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় কলেজে না যাবার। সে হেলেদুলে ধীর কদমে হাঁটতে থাকে, তার উদ্দেশ্য উদ্দেশ্যহীন হোয়ে যাওয়া!
সে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশ খুটিয়ে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ তার চারপাশের সবকিছু অপরিচিত হোয়ে ওঠে। নরম আলোয় ভরা অপূর্ব সকাল। পথের মানুষ আর দু'পাশের ঘর-বাড়ি, দোকান সবকিছু মনে হয় তার আজই প্রথম দেখছে।
একটা মেয়ে হেঁটে আসছে ফোফানো ফ্রক আর হাঁটুর নিচে নেমে হঠাৎ থমকে যাওয়া টাইসপরা। তার পিছনে জোরে হেঁটে আসছে একটা ছেলে, মেয়েটার কাছাকাছি হবার জন্য। আদি থেকেই ছেলেরা এভাবে জোরে হাঁটছে। মেয়েদের সঙ্গ পাবার জন্য। কারা যেন বাজনা বাজাচ্ছে। ঝমর ঝমর, গাছ পাতার ভেতর থেকে বেরোচ্ছে পাখীর গান। হঠাৎ চারপাশ ভোরে ওঠে ছাতিয়ান ফুলের তেজি মিষ্টি সৌরভে!
সে একই পথে তিনবার আসে যায়। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার কাছে সবকিছু নতুন মনে হয়। পথ তার কাছে মনে হয় চেনা-চেনা কিন্তু অচেনা।
সে পথের পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে একটা গাছের পাতা ছেড়ে। পাতাটা হাতের ভিতরে চটকে নাকের কাছে ধরে আর শ্বাস টেনে বলে, 'বেল পাতা'!
এবার সে সোজা হাটে আর ভাবে 'এখন থেকে যা যা দেখবো তার সব আমি একটার সাথে আর একটা জোড়া দিয়ে যাবো, হোক সে যতই পরস্পর সম্পর্কশূন্য। তাহলে কীভাবে শুরু করা যায়? কাহিনীটা কী হবে?'
সে আদা পেঁয়াজ-রসুন ঝালের ঝাঁজে ভরা কাঁচা বাজারে ঢুকে পড়ে। এখানে সে একটা খাঁচার দাড়ে বসা মানুষের ভাষায় কথা বলা ময়নাপাখী দ্যাখে। পাখীটা অনর্গল বলে যাচ্ছে 'ও মাদার ও ফাদার ও ব্রাদার গিভ মি সাম ফুড'। নগুহো নোংরা জল ভরা একটা গর্তে পড়তে পড়তে দু'হাত শূন্যে মেলে কোনো রকমে তাল সামলে এ যাত্রা বাঁচে।
হঠাৎ তার মনে পড়ে কি জন্য সে বেরিয়েছে। ব্যাজারমুখো ব্যাপারী। বিমর্ষ লাউ। নির্লজ্জ পেঁপে, বেসাইজ কচুরমুখী, আর কমনীয় কাঁচাকলার দিকে তাকিয়ে সে একটা লম্বা শোকের নিঃশ্বাস ছাড়ে, আর বলে 'যারা বিক্রি কোরছে, যারা খায় আর যারা ফলায় তারাও এসব কাঁচাকলা, পেঁপে, কচুরমুখী ঝাল পেঁয়াজের মাঝে কোনো কাহিনী খুঁজে পাবে না। অবশ্য এসব তরি তরিকারির ইতিহাস আছে। কিন্তু কোনো গল্প নেই।' হতাশা তাকে এখান থেকে বের করে আনে মাছ বাজারে। এখানে ভিড় অনেক বেশি।
সারি সারি ডালার ওপর সাজানো বিভিন্ন জাতের মাঝ। মাছঅলারা তাকে ডাকে 'স্যার আহেন লন, একদোম তাজা।'
চিল্লাচিলি্ল, ভিড়, দর কষাকষি, পঁচা অাঁশটে গন্ধ তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বাজার থেকে বের কোরে দেয় ...।

পথের গরম তাকে ঘামাতে থাকে। তবুও বাজারের খপ্পর থেকে মুক্তি পেয়ে সে খুশি হয়। কিন্তু এক ধরনের সঁ্যাতসেতে ক্লান্তি তাকে জড়িয়ে ধরে। সে বলে নিজেকে 'যৌবন আমাকে ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছে, সাথে নিয়ে যাচ্ছে সুখ-শান্তি, সজীবতা; সে যাই হোক এখনও আছে অনেক সক্ষমতা। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। আর জগতে রেখে যেতে হবে কিছু কাজ, যারা অনন্ত আগামী জুড়ে ঘোষণা কোরতে থাকবে আমার নাম।'

নগুহোর ক্ষিধে লাগাতে পথের পাশের চায়ের দোকানে বসে সে পাউরুটি কলা খায়। চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে দোকানদারের মুখের দিকে সে তাকায়, সাথে সাথেই তার ধারণা হয় চায়ের দোকানদার নির্ঘাত মোঘল বংশের অপভ্রংশ! মুহূর্তে তার সামনে চলে আসে প্রথম পানিপথের যুদ্ধ! যুদ্ধ শব্দটা তার ভিতরে একটা দরোজা খোলে। সে বলে 'আমিও যুদ্ধে লিপ্ত। মূলত সবাই কোনো না কোনো যুদ্ধে লিপ্ত। সেই অর্থে দুনিয়াটাই যুদ্ধক্ষেত্র আর দুনিয়ার সবাই যোদ্ধা!
আমার যুদ্ধে কামান-বন্দুক, তলোয়ার ঝন ঝনা নাকাড়ার উপস্থিতি না থাকলেও এটা যুদ্ধ। যুদ্ধে এক পক্ষ জিতবে এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধে হিংস্রতা অনিবার্য এবং শ্বাশত। আমি জিততে চাই। তাহলে কি বিষয়টা নিয়ে আমি গালচে ফোলা কামালের সাথে কথা বলবো? গালচে ফোলা কামালকে কয়েকটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিলেই সুলতান মাহামুদ রতন রুগী হিসেবে পঙ্গু হাসপাতালে যাবে। আর নোটের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিলে সুলতান মাহামুদের জানাজা হাবে। যুদ্ধ আইন, বেআইন, বৈধ, অবৈধ, নিরপেক্ষ। যুদ্ধে যে জিতবে তার সবকিছুই বৈধ। আর যে হারবে সে নিজেসহ তার সব কাজ অবৈধ। কিন্তু সুলতান মাহামুদ মরে গেলেও আমার কোনো লাভ নেই। আমি পরাজয় চাই তার গল্পের গল্পকারের গল্প না থাকলে সে জিরো। আমার গল্পের জয় চাই আমি।
তার চিন্তা তছনছ করে দিয়ে একটা ট্রেন আসে। কিছু যাত্রী ওঠে কিছু নামে। তারপর ট্রেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিম পাড়ে!
তার ইচ্ছে হয় ট্রেনে উঠতে। সে বলে ফিস ফিস 'ট্রেন আমাকে নিয়ে যাক যে কোনো দিক, দুনিয়ার রেল লাইন ধরে শুধু চলতেই থাকি। কোনো গন্তব্য নেই, কোথাও যাবো না আমি শুধুই পথিক!'
ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে নগুহো বলে আনমনে। 'ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যা হয় হয়, স্টেশনে আমি বসে, প্লাটফরমের ঐ পাড়ে বৃষ্টির সম্ভাবনায় বিরাট এক চাক সুরমাই মেঘ ঝুলে পড়েছে। জ্বরপ্রবণ এই বৃষ্টি গায়ে লাগলে সর্বনাশ! এবার উঠতে হচ্ছে। দিনটা আমাকে ঘুরিয়ে ক্লান্ত কোরেছে। আমি আজীবন এ শহরে অথচ আজ বোঝা গেলো আমার আজন্মের শরীরের মতো এই শহরটা আজও আমার কাছে অচেনাই থেকে গেছে। আমি বুঝতে পারি না মানুষ কেনো এতো অপ্রয়োজনীয় শব্দ করে। একটা হাঁস কিংবা কুকুর বিনা প্রয়োজনে কোনো শব্দ করে না। অথচ মানুষ অহেতুক কাই মাই কোরতেই থাকে।' সে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে আর নিজেকে টেনে তোলে, তারপর স্টেশনের বাইরে এসে তার মনে হয় 'কারা বা কে কাজটা কোরছে তা এই মুহূর্তে বোঝা না গেলেও আমাকে আসলে পরিকল্পনা করে অপদস্থ করা হচ্ছে। আমি সবাইকে দেখে নেবো। সবাইকে দেখিয়ে দেবো।'
সে রেগেমেগে মন খারাপ করে রিকশা ডেকে উঠে পড়ে।

এরপর থেকে নগুহো প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হয়, ফেরে রাতে।
কোথায় যায়, কী করে, কেহ জানে না। কয়েকদিন পর তার কলেজ থেকে একজন আসে। স্বাভাবিকভাবেই তাকে বাড়িতে পায় না। সে ফিরলে বউ তাকে খবরটা দেয়।
সে বউকে বলে 'আমি আর ওখানে যাবো না।'
'কেন?'
'তোমার কোনো সমস্যা আছে? কত টাকা দেয় কলেজ? প্রাইমারির চাকরিও এরচে হাজারগুণ ভালো। গত বছরের সেপ্টেম্বরের বেতন পেয়েছি এ বছর মার্চে। তারপর তিন মাস গেছে, অক্টোবরের বেতন কবে পাবো তার কোনো ঠিক আছে? জমি আর ঘর ভাড়া দিয়েই যখোন আমরা চলি, তখোন ওখানে ব্যাগার খাটার কোনো অর্থ আছে?'
'কলেজ তো একদিন সরকারি তালিকাভুক্ত হবে, তখোন তো সব ঠিক হয়ে যাবে।'
'ভূমিকম্প এসে কবে সুন্দরীকে নাচাবে আর আমরা নাচ দেখবো। সে অনিশ্চিত অপেক্ষায় আমরা বসে বসে আয়ুক্ষয় কোরতে পারি না, আমি নগদ তিতপুটি পেলেই খুশি বাকি তিমি মাছের দরকা নেই আমার।'

তারপর থেকে নগুহো সম্পর্কে লোকেরা বলে,
'গুলজার মাস্টেররে দ্যাকলাম সামনে তাকায়ে ফাছে হাঁটতেছে।'
'গুলজার শাবল হাতে ঘুরে ব্যাড়াচ্ছে আর ইহানে উহানে গর্ত খুচে কি যেনো খুঁজতিছি।'
'তার ঘাড়ে জেনের আছর হোইছে, সে একা একা কথা কয়।'
'সে লাফ দেয়, দোড়োয় ফাঁকা মাঠে।'
'সে সারা গায় তাবিজ বান্দিছে।'
'সে বাড়িতে চঁ্যাচামেচি করে, থালা-বাটি ভাঙ্গে।'
'কেউ খায়ে টাল হয়, আমাগে গুলজার না খায়েই টাল।'
'গুলজার ডাইরি হাতে পথে পথে ঘোরে।'
'সে মাজারে জোড়া খাসি মানত কোরিছে।'
তারপর তার সম্পর্কে আর শোনা যায় না কিছুই, আর তাকে দেখা যায় না শহরে।
বেশ কিছুদিন ...।

হঠাৎ এক শনিবার নগুহো বিখ্যাত হোয়ে ওঠে। সবার মুখে মুখে কেবল তার নাম, তারই নাম ধ্বনিত সব জায়গায়। সব কয়টা দৈনিকের পাতা জুড়ে, টিভি সংবাদে নগুহোর নাম আর কীর্তি।
কয়েকটা কাগজে ক্রোড়পত্র তৈরি কোরেছে।
সংবাদের সারাংশ এরকম ... গত দুপুরে আলহাজ্ব হারুন অর রশিদ ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক নকীব গুলজার হোসেন তার গ্রামের বাড়ি বুড়িরহাট গ্রামের তার জমির বর্গাচাষী এমদাদুলের স্ত্রী চামেলী বেগমের সাথে আপত্তিকর কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে। এমদাদুল সে সময় একই গ্রামের কাশেম জোতদারের বাগানে কাজ কোরছিল। তার বৌয়ের অপকর্মের সংবাদ তাকে আমগাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়।
গুলজার হোসেন এবং চামেলী বেগমকে পুলিশ এসে গ্রামবাসীদের হাত থেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গেছে। এমদাদুলের লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে।

নগুহো অনেক চেষ্টা করেও গল্প খুঁজে না পেলেও এবার সে নিজেই গল্প হোয়ে উঠেছে।
আর হাশেম মিয়া তাকে বিষয়বস্তু করে বিভিন্ন আঙ্গিকের কয়েক ডজন গল্প সাজিয়েছে ...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # গল্প ভালো তবে-----, একটু কেমন কেমন যেন হয়েছে ।
ঐশী মুগ্ধতা রেখে গেলাম মিজান ভাই !
নাসরিন জাহান লিপি এই মানের গল্প আর একটাও এখানে পড়িনি.....
সূর্য মাইন্ড ব্লোয়িং যাকে বলে একেবারে তেমন একটা গল্প। এটা যেন গল্পকবিতারই কতগুলো নগুহোর কাহিনী। ভাষার ব্যবহার, কাহিনীর প্রক্ষেপন, বুনট সবকিছু মিলে-মিশে একেবারে সোনায় সোহাগা।
আহমেদ সাবের গল্পের খোঁজে চর্কির মত ঘুরতে থাকা নকীব গুলজার হোসেনের নিজেরই গল্প হয়ে যাবার দুর্দান্ত এক কাহিনী নিয়ে অসাধারণের চেয়েও অসাধারণ একটা গল্প।
জয়নাল হাজারী মন্তব্যকারীর এত অভাব কেন ভাই ? আমার দায়িত্ব পুরা করে গেলাম।বেলুন ফুলালাম না।
জাফর পাঠাণ টার্নিং...টার্নিং.....টার্নিং....অনেকগুলো টার্ন ঘুরে এসে মায়া আর মদ্দার মত চুম্বকধর্মী জনপ্রিয়তার ঘরে এসে শেষ হলো বাস্তব প্রদর্শণমূলক গল্পটি ।গভীর অর্থপূর্ণ গল্প ।মোবারকবাদ মিজান ভাই।
মিলন বনিক অনেক দীর্ঘ গল্প...আর নগুহোর গল্পকার হয়ে উঠার কাহিনীটা সোত্যুএ চমকপ্রদ...চরিত্র চিত্রণ আর সাবলীল বর্ণনায় গল্পটা অনেক বেশি আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে....খুব ভালো লাগলো...
সেলিনা ইসলাম অলীক কল্পনায় গাঁথা অনেক সুন্দর গল্প খুব ভাল লাগল তবে সাইফাই গল্প হল না। শুভকামনা রইল প্রিয় লেখকের জন্য ।
বিন আরফান. হাহ! একেবারেই হাপিয়ে পড়েছি . তবে বিরক্ত বোধ করিনি. কেননা প্রতিটি বাক্যের গাথুনি মনে ধরেছে বটে. আর আমি বিষয় ভিত্তিক লেখা পছন্দ করিনা. এতে লেখকের স্বাধীনতা থাকেনা. তাই অসাধারনেই হাত বুলালাম. ভালো থাকবেন.

০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪